স্বাগতম বেসরকারি শিক্ষক কমিশন : তবে কিছু সমস্যা Welcome to Prevate commission : However, Some problems ,
বেশ কয়েকদিন আগ থেকে তথা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ গৃহীত হওয়ার পর থেকে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলাদাভাবে কমিশন গঠনের কথা শোনা যায়। কিছুদিন এ আলোচনা বন্ধ থাকলেও গত ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ডিসিদের সম্মেলনে ডিসিরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, আর ভয়াবহ আর্থিক লেনদেনের কারণ দেখিয়ে এসব নিয়োগের ক্ষমতা তাদের হাতে দেয়ার জন্য আবেদন করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন (সূত্র : দৈনিক কালেরকণ্ঠ, ১৪ অক্টোবর ১৫) সেই থেকে বিষয়টি আবারও সবার নজরে আসে। সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিব ও মাউশির চেয়ারম্যান উপস্থিত হয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের কথা জানান। যা হবে পিএসসির প্রতিবিম্ব। আমাদের দেশে মোট ১৯ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাড়ে ৩ হাজার কলেজ, সাড়ে ৯ হাজার মাদ্রাসা ও ৭৭৩টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৩৩ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশের দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করে। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক জায়গায় দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দেয়ায় বা যোগ্য প্রার্থীকে আকৃষ্ট না করায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃত ও ভালো মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে যতগুলো কারণ রয়েছে তন্মধ্যে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগের সময় বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন বা এই লেনদেনকে কখনও কখনও ডোনেশন বলে অভিহিত করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এ বিষয়ে দেশের সব নাগরিকের পক্ষ থেকে সরকারের আশু দৃষ্টি কামনা করছিল এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে এক প্রকার বাধ্য হয়। সরকারের নেয়া উক্ত পদক্ষেপটি সত্যিই প্রশংসনীয় এবং দেশের মেধাবী শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে কৃতজ্ঞতার দাবি রাখে। তবে এক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা আরও স্পষ্ট করা প্রয়োজন যেমন_১. শিক্ষা সচিব সংবাদ সম্মেলনে জানান গত ১২ বছরে এনটিআরসিএ-র পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার ২৯ জন প্রার্থী কিন্তু এদের মধ্যে চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৬৩ হাজার ৪২ জন। চাকরি পাওয়া প্রার্থীদের বাদ দিলে শিক্ষা সচিবের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিবন্ধন পাস করে চাকরি পায়নি এমন সংখ্যা হলো প্রায় ৪ লাখ ৭৭ হাজার এদের মধ্যে হয়তো ২ লাখ প্রার্থীর অন্যত্র চাকরি হয়ে গিয়েছে কিন্তু বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার প্রার্থীর কপালে কি ঘটবে? এসব প্রার্থীর কি আগামী ৩ বছরের মধ্যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি জুটবে? অথবা, এসব প্রার্থীদের কি কোন অগ্রাধিকার দিয়ে মেধা তালিকা প্রণয়ন করবে?২. শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন খুব শীঘ্রই পিএসসির আদলে কমিশন গঠন করা হবে এবং বিসিএসের আদলে শিক্ষক চাহিদা বিবেচনা করে এর থেকে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ বেশি প্রার্থী উত্তীর্ণ করা হবে। এখন প্রশ্ন জাগে, নতুন পাস করা এসব প্রার্থীর সঙ্গে পূর্বে পাস করা প্রার্থীদের কিভাবে সমন্বয় করা হবে? কেননা পুরনো প্রার্থীদের অনেকেই এনটিআরসির শর্তমতে শুধু পাসই করেছেন, সেখানে ভালো নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে এরকম কোন পুরস্কার বা অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়নি ফলে এসব প্রার্থীদের অধিকাংশেরই গড় নম্বর ৬৫-৭০ শতাংশের কম কিন্তু এবারে যেসব প্রার্থী পরীক্ষা দেবে তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ৮০-৯০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে ফলে এখানে সমন্ব্বয়হীনতার সম্ভাবনা রয়েছে।৩. শিক্ষামন্ত্রী পিএসসির আদলে কমিশন গঠনের কথা বললেও গত ২৮ জুলাই ডিসিদের সম্মেলনে ডিসিরা এ বিষয়ে তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানান। যেখানে ডিসি ছাড়াও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউএনও, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা থাকবেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা এতে আপত্তি তুলে তা শুধু পিএসসির আদলে যেভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ পেয়ে থাকে সেভাবে নিয়োগ দেয়ার দাবি জানান। তাদের যুক্তি স্থানীয় ও আঞ্চলিক নেতাদের চাপের মুখে প্রশাসনের এসব কর্মকর্তা আগের মতো নিয়োগ বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতি করতে পারে, ফলে যে উদ্দেশ্যে এনটিএসসি গঠন করা হচ্ছে তা বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। আবার এটি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তারা মনে করেন।৩. বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু শিক্ষক নিয়োগই নয় বরং শিক্ষক বহিষ্কার বা, চাকরিচ্যুতির ক্ষমতাও কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কেননা শিক্ষক বহিষ্কার ও চাকরিচ্যুতির যেসব ঘটনা আমরা সাম্প্রতিক সময়ে শুনতে পাই তাতে রয়েছে দলীয় হিংসা আর ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা দ্বন্দ্ব। এছাড়াও নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ দিলে সেখানে যদি স্থানীয় নেতা কিংবা প্রভাবশালীর কোন প্রার্থী নিয়োগ না পেয়ে যদি অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকে তবে কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রার্থীকে নিয়োগ দেবে ঠিকই কিন্তু নিয়োগকৃত প্রার্থীকে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়াবে অথবা মিথ্যা অভিযোগে শোকজ বা চাকরিচ্যুত করে অপেক্ষমাণ থাকা পরবর্তী প্রার্থী তাদের লোক হলে তাকে নিয়োগ দেবে। এ আশংকার জের ধরে আমাদের দাবি হলো- কোন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করতে হলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির করা সুপারিশের পরে কেন্দ্রীয়ভাবে বিষয়টি তদারকি এবং তদন্ত করে পরে যাতে ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর এটি না হলে শিক্ষকরা অনেকটাই লাঞ্ছনার শিকার হবেন এবং বিষয়টি আবারও আগের মতো স্বজনপ্রীতি আর আর্থিক লেনদেনের ঘটনা ঘটবে।৪. প্রতিবছরই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন পায় এগুলোর কোন কোনটি এমপিওভুক্তির আবেদন করে আবার কতকগুলো করে না কিন্তু যেগুলো এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করবে এ মনোভাব রেখে প্রতিষ্ঠান চালু করল সেগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হবে কিভাবে? এখানেও কি কমিশন একইভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেবে? প্রশ্নটা এ কারণেই আসলো যে, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পদগুলো হবে সৃষ্ট তথা, প্যাটার্নভুক্ত পদ সেক্ষেত্রে সরকারি কোষাগার থেকে তারা কোন বেতন-বোনাস পাবে না। তবে কি একজন মেধাবী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে ইচ্ছুক হবে?৫. অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে ২-১০ বছর তবে এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি এসব শিক্ষকরা কি নতুন পদ্ধতির আওতায় আসবে? কেননা, শিক্ষা সচিব যে ৬০ হাজার প্রার্থী শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন বলে তথ্য দিয়েছেন সেখানে এসব কলেজের শিক্ষকরা অন্তর্ভুক্ত কিনা তা খোলাসা করে বলেননি? আর যদি এসব শিক্ষকরা আওতায় আসে তবে ২০ শতাংশ বেশি প্রার্থী নিয়ে যে মেধা তালিকা প্রণয়ন করবেন বলে জানিয়েছেন সেক্ষেত্রে এক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হবে।৬. দেশে বিদ্যমান স্কুল, কলেজগুলোতে কিভাবে প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, সহকারী প্রধান বা উপাধ্যক্ষ নিয়োগ হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এসব পদকি স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হবে নাকি এনএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হবে সে সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি।৭. পূর্বে যেমন একজন শিক্ষক ভালো কোন কলেজে সুযোগ পেলে সেখানে সে যেতে পারত বা আবেদন করতে পারত বর্তমান শিক্ষা কমিশনে এরূপ কি কিছু থাকবে? নাকি একজন শিক্ষক যে প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আছেন বা, যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাবেন সেখানেই তাকে আজীবন চাকরি করতে হবে এবং এখান থেকে তাকে অবসর নিতে হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করা উচিত।৮. এবার আসা যাক নিয়োগ সুপারিশ সর্ম্পকে, এখানে বলা হয়েছে পিএসসির আদলে যে পরীক্ষা নেয়া হবে সেখানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করবে এক্ষেত্রে এই একটি পরীক্ষাকে মানদ- হিসেবে ধরা হয়েছে এবং সে যে পূর্ববর্তীতে অনেক ত্যাগ আর কষ্টের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এবং কোন কোন প্রার্থী ১ম- ৩য় স্থান অধিকারী হয়েছে সেগুলো বিবেচনা নেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি যেহেতু এটি একটি প্রফেশনাল জব তাই এসব বিষয় বিবেচনা করা জরুরি।৯. শিক্ষক পদায়ন ও বদলির কথা কিছু বলা হয়নি এর ফলে একজন শিক্ষক একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে বাধ্য হবে ফলে দলাদলি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।১০. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক প্রত্যেক ডিগ্রি কলেজে প্রতিটি বিষয়ের জন্য তৃতীয় শিক্ষক নেয়ার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে কিন্তু তা এমপিওভুক্ত হয় না অর্থাৎ এ পর্যন্ত যতজন এ পদে নিয়োগ পেয়েছেন কেউই এমপিওভুক্ত হননি। এদের কি হবে? বা এরকম আরও পদ খালি হলে এসব পদে শিক্ষক নিয়োগ হবে কিভাবে ?১১. কলেজের বা স্কুলের অন্তর্ভুক্ত কোন বিষয়কে পরিবর্তন বা বাতিল করার ক্ষমতা যেন কমিটির হাতে না থাকে সে ব্যবস্থা নেয়া দরকার কেননা এতে করে কোন শিক্ষককে বহিষ্কার করতে চাইলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ দুই-এক বছর উক্ত বিষয়ে কাম্য সংখ্যক বা কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে পরে বোর্ডের নিকট উক্ত বিষয়টি বাতিলের সুপারিশ করে ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষককে বহিষ্কার করে ব্যক্তিগত আক্রোশ মোটানোর চেষ্টা করে।সর্বোপরি, পিএসসির আদলে যে পৃথক শিক্ষা কমিশনের কথা বলা হয়েছে তা দেশের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই এ পদক্ষেপের জন্য সরকারকে ভূয়সী প্রশংসা করছেন তবে উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোন সমাধান না দিয়ে এ কমিশনের যাত্রা শুরু হলে সরকারের নেয়া এ মহতি উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে । তাই শিক্ষা ও শিক্ষকের মান নিশ্চিত করতে পারলে আগামী দিনে আমরাও মানসম্মত ও দেশ পরিচালনার যোগ্য নাগরিক পাব। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকের সর্বর্োচ্চ মর্যাদা দিয়ে এ বিভাগে আরও বেশি ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে তবেই মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে এবং দেশ-জাতি সর্বোপরি ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়িত হবে।
লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ-ইস্ট ডিগ্রি কলেজ।