Pay - scale solution to crisis পে-স্কেল সংকটের সহজ সমাধান
অষ্টম পে কমিশনের সুপারিশ প্রদানের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ওই আন্দোলন সরকারের নজর কাড়তে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু শিক্ষকদের আন্দোলন সত্ত্বেও মন্ত্রিপরিষদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বার্থবিরোধী পে-স্কেল পাস হয়েছে। অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের এই আন্দোলনে রুষ্ট হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় স্পষ্টতই বলেছেন, তিনি শিক্ষকদের আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি।
তবে সরকারের প্রধান নির্বাহী ও প্রভাবশালী মন্ত্রীদের কড়া সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন তথা শিক্ষকরা এখনো তাদের দাবিতে অনড় রয়েছেন। তারা আশা করছেন, সরকারের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ সবার ভুল ভাঙবে এবং তারা অসৎ আমলাদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি অচিরেই আমলে নেবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য কমিশন গঠন করবেন।
আর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের দাবিমতো যত দিন স্বতন্ত্র পে স্কেল বাস্তবায়িত না হয় তত দিন পর্যন্ত সপ্তম পে স্কেলের মতো অষ্টম পে স্কেলেও শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন সর্বোচ্চ গ্রেডে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
দুই.
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা উল্লেখ থাকলেও অষ্টম পে কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত ওই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে কখনোই উচ্চবাচ্য করা হয়নি; যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরা সব সময় মনেপ্রাণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চেয়েছেন। তবে জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছর বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য না হওয়ায় ধরে নেওয়া যায় অষ্টম পে স্কেলে যদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সপ্তম পে স্কেলের মতো মর্যাদা ও বেতন প্রদান করা হতো, তবে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেলের দাবির বিষয়টি আর উচ্চারিত হতো না।
গত কয়েক মাসের ফেডারেশনের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেলের দাবি যতবার উচ্চারিত হয়েছে তার চেয়ে সপ্তম পে স্কেলের সঙ্গে অষ্টম পে স্কেলে বৈষম্যের বিষয়টি বেশি আলোচিত হওয়ায় আমার কাছে এমনটি মনে হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের একমাত্র দাবি উত্থাপন না করায় বিষয়টি স্পষ্ট যে তাদের কাছে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিটি মুখ্য নয়। সপ্তম পে স্কেলের মতো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন অষ্টম পে স্কেলে প্রদান করা হলেই তারা সন্তুষ্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি স্বতন্ত্র পে স্কেল হলেও তারা যে শেষ পর্যন্ত ফেডারেশন দেখানো পথে হাঁটবেন তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, স্বতন্ত্র পে স্কেলের দাবি উত্থাপন তাদের আন্দোলনের একটি কৌশলমাত্র। তারা স্বতন্ত্র পে স্কেলের দাবি তুলে সরকারকে চাপে রেখে অষ্টম পে স্কেলে তাঁদের যথাযথ মর্যাদা ও বেতন নিশ্চিত করতে চান। তাই সরকারের উচিত হবে সময়ক্ষেপণ না করে শিক্ষকদের ওই মনোভাব উপলব্ধি করে সপ্তম পে স্কেলের মতো অষ্টম পে স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা ও বেতন নিশ্চিত করে বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসা।
তিন.
সরকার চাইলে খুব সহজেই সহজ উপায়ে এ সংকটের সমাধান করতে পারে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ গ্রেডে যাওয়ার বিষয়টি কোনো পে স্কেলের বিষয় নয়। ১৯৮৭ সাল থেকে তাঁরা এ সুবিধা পেয়ে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ১৯৮৬ সালের ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনবলে (২৮ জানুয়ারি ১৯৮৭ বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত) তাঁদের এই সুযোগ প্রদান করা হয়। আর তখন থেকেই প্রতিটি পে স্কেলে তাঁরা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের সুবিধা পান।
১৯৮৬ সালের ওই আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তৃতীয় গ্রেডে চাকরি করলেও টাইম স্কেল পাওয়ার মাধ্যমে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হন। আর দ্বিতীয় গ্রেডে পাঁচ বছর চাকরি করার পর শর্ত সাপেক্ষে প্রথম গ্রেড বা সর্বোচ্চ গ্রেডে উন্নীত হন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অধ্যাপকই প্রথম বা সর্বোচ্চ গ্রেডে উন্নীত হওয়ার সুযোগ পান বিষয়টি এমন নয়। ওই গ্রেডে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়া ও শর্তগুলো অনেক জটিল হওয়ায় অনেক অধ্যাপকই প্রথম গ্রেডে উন্নীত হওয়ার আগেই অবসরে চলে যান। আর এ ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট অনুমোদিত অধ্যাপক পদের ২৫ শতাংশ অধ্যাপক ওই পদে পদোন্নতি পাবেন এমন শর্তই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক দশক পার করলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একজন অধ্যাপক গ্রেড-১ বা সর্বোচ্চ গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো এমনটি বলার সুযোগ নেই। কুমিল্লা অথবা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রেড-১-এ উন্নীত হওয়া কোনো অধ্যাপক নেই। তাই সরকার যদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সুযোগ প্রদান করে, তবে সব অধ্যাপকের পক্ষে ওই পদে যাওয়া সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরনো চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক বা একাধিক শিক্ষকের পক্ষে ওই পদে উন্নীত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিলে রাষ্ট্রের খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে প্রজ্ঞাপনবলে গত প্রায় ৩০ বছর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকরা জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ গ্রেডে যাওয়ার যে সুযোগ পেয়ে আসছেন তা হঠাৎ করে বর্তমান পে স্কেলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন?
আর যত দূর জানি, পে কমিশনের প্রতিবেদনেও ১৯৮৬ সালের প্রজ্ঞাপন বাতিল করার কোনো সুপারিশ করা হয়নি। তাই সরকারের উচিত হবে ১৯৮৬ সালের প্রজ্ঞাপন আমলে নিয়ে শিক্ষকদের আস্থায় নিতে ওই প্রজ্ঞাপন বহাল আছে এমন নির্র্দেশনা জারি করা। প্রয়োজনে পে স্কেলের গেজেটে সেই বিষয়টি উল্লেখ করা। তবে ওই প্রজ্ঞাপন আমলে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টি এমন নয়।
কারণ এর আগে কোনো পে স্কেলেই মন্ত্রিপরিষদসচিব ও সিনিয়র সচিবদের জন্য আলাদা কোনো গ্রেড ছিল না। তারা সবাই সচিবদের সমান গ্রেড-১ স্কেলে বেতন পেতেন। কিন্তু অষ্টম পে স্কেলে গ্রেড-১ স্কেলের ওপর আরো দুটি সুপারগ্রেড তৈরি করায় নতুন বিপত্তি সৃষ্টি হয়েছে; যদিও শিক্ষক নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে ও সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে বিশেষ বিবেচনায় তারা মন্ত্রিপরিষদসচিবের পদ আলাদা হওয়া মেনে নিতে পারেন। তবে কোনোভাবেই সিনিয়র সচিব পদকে মেনে নেবেন না। তাই এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে নতুন আরো একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে শর্ত সাপেক্ষে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের ১৫ শতাংশকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত হওয়ার সুযোগ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র সচিবের মতো প্রকাশ্য সিনিয়র অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।
আগের মতো অধ্যাপকরা যেভাবে টাইম স্কেল পেয়ে দ্বিতীয় গ্রেড ও সিলেকশন গ্রেড পেয়ে প্রথম গ্রেডে উন্নীত হতেন, এবারও তারা সুপার সিলেকশন গ্রেড পেয়ে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত হবেন মাত্র। তবে সবার পরিচয় হবে অধ্যাপক। অন্যথায় নতুন করে পদ সৃষ্টি করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন সংকটে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একাডেমিক ডিজঅর্ডার তৈরি হবে।
পরিশেষে বেতনবৈষম্য নিরসন জাতীয় কমিটি অথবা অন্য কোনো নতুন কমিটি করে কালক্ষেপণ না করে বর্তমান সংকট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ১৯৮৭ সালের প্রজ্ঞাপন বহাল রেখে সুপার সিলেকশন গ্রেডের কথা উল্লেখ করে নতুন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সূত্র: কালের কণ্ঠ।